২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |
  • প্রচ্ছদ
  • সারাদেশ
  • গজারিয়া গণহত্যা এক বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিশোধের গল্প
  • গজারিয়া গণহত্যা এক বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতিশোধের গল্প

    মুক্তি কন্ঠ

    মুক্তিকন্ঠ ডেস্ক :

    ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। রমনা রেসকোর্স ময়দানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে বক্তব্য অনুপ্রাণিত করেছিল দেশের মানুষকে। ব্যতিক্রম ঘটেনি আব্দুল খালেক আলোর সঙ্গেও। অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তিনিও।

    শেষ পর্যন্ত সেই বক্তব্য আব্দুল খালেককে যুদ্ধের মাঠে ডেকে নিয়েছিল। ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিতে নিজ গ্রামে গিয়ে লড়াইয়ের জন্য স্থানীয়দের জড়ো করতে শুরু করেন তিনি।

    মার্চ মাসের শেষের দিকে গ্রামে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক। সে সময় তার ডাকে সারা দিয়েছিলেন অনেকেই। যুদ্ধক্ষেত্রে অপারেশনের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি।

    এ সময় তিনি ‘আলোর দিশারী’ নামে একটি স্কুল গড়ে তোলেন এবং ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেন। যেখানে লড়াইয়ে যোগ দিতে ইচ্ছুক এমন ২০০ জনেরও বেশি যুবক ও বয়স্ক লোক জড়ো হয়েছিলেন।

    এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে উৎসাহ দেওয়া। এ ছাড়া অস্ত্র সম্পর্কেও প্রাথমিক তথ্য শেখানো হয়েছিল। গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ওয়ালী উল্লাহ জমাদ্দার ছিলেন তাদের প্রধান প্রশিক্ষক।

    আলোর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন ছোট ভাই মোয়াজ্জেম হোসেন এবং বড় ভাই আব্দুর রউফ (যিনি তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন)। তাদের সঙ্গে মে মাসের প্রথম দিকেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এরই মধ্যে তাদের ওপর হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা হয়।

    গজারিয়ার তৎকালীন শান্তি কমিটির সদস্য খোকা চৌধুরী এবং এলাকার চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহফুজুল্লাহ তাদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে রিপোর্ট করেছিলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালের ৯ মে গজারিয়ায় হামলা চালানো হয়েছিল।

    সেদিন সকাল ৬টার মধ্যেই সোনালি মার্কেট এলাকায় রাস্তার ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ছাত্র-কৃষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ ১১০ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রান্ত গ্রামগুলোকে থেকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয় মোট ৩৬০ জনকে। কাফনের কাপড়ের অভাবে কলাপাতা আর পুরোনো কাপড় পেঁচিয়ে নিহত স্বজনদের ১০টি গণকবরে দাফন করেছিলেন গ্রামবাসী।

    তবে পাকিস্তানি বাহিনী ওই দিন শুধু নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। সমানতালে ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ গ্রামবাসীদের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল।

    তবে তাদের লক্ষ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক আলো এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ‘আলোর দিশারী স্কুল’। ওই এলাকার রাজাকার কালু মিয়া পাকিস্তানি বাহিনীকে সরাসরি স্কুলে নিয়ে গিয়েছিল।

    হামলায় গজারিয়া, নয়ানগর এবং গোসাইরচর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই এলাকাগুলোর প্রতিটি বাড়িতেই সেদিন অন্তত একজনের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু শান্তি কমিটির সদস্যদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

    যখন সামরিক বাহিনী তাদের ওপর হামলা চালায়, গ্রামবাসী আবদুল খালেকের কাছে জানতে চেয়েছিল তারা কোথায় লুকাবে। পাকিস্তানি সেনারা সাঁতার কাটতে পারে না বলে তাদের নিকটবর্তী নদীর চরে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু বিপদের মুখে আব্দুল খালেক ভুলে গিয়েছিলেন হানাদার বাহিনীরা স্পিডবোটে এসেছে।

    আবদুল খালেকের সেই পরামর্শ মতে নদীর চরে যান গ্রামবাসীরা। যার ফলে সেই চরে থাকা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে অনেক গ্রামবাসী প্রাণ হারায়। শুধু গ্রামবাসী না, ওই দিন প্রাণ হারান তার ছোট ভাই মোয়াজ্জেমসহ তার পাঁচ চাচাতো ভাই ও চাচা।

    চরে গিয়ে পাক বাহিনী যখন নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছিল, তখন হতবাক হয়ে যান আব্দুল খালেক। তবে তাৎক্ষণিক একটি পরিকল্পনা তাকে আশার সঞ্চার করে। তিনি দৌড়ে যান গ্রামেরই অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা সদস্যের বাড়িতে। আব্দুল খালেক তাকে বলেন, ‘আপনার বন্দুকটি আমাকে দেন। আমি শুধু একটি গুলি করতে চাই, শত্রুপক্ষকে জানাতে চাই আমরা এদিকে অবস্থান করছি এবং গুলি চালাচ্ছি’। এই পরিকল্পনার কারণ ছিল অন্তত একটি গুলি করতে পারলেও পাকিস্তানিরা গুলির শব্দের উৎসের দিকে মনোযোগ দেবে। এতে অন্তত আধা ঘণ্টা সময় পেতেন গ্রামবাসীরা। যে সময়ের মধ্যে তারা নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেদিন ওই ব্যক্তি বন্দুকটি দেননি। নিরুপায় হয়ে খালের পানির কচুরিপানার নিচে আত্মগোপন করেন আব্দুল খালেক।

    এ ঘটনার পরে সবাই সন্দেহ করেছিল আবদুল খালেককে। সবাই শুধু ফলাফল দেখেছিল, কিন্তু আব্দুল খালেকের পরামর্শের পেছনের যুক্তি-বিবেচনা সেদিন কেউ করেনি। সেদিন তার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেউ দেখতে আসেনি।

    এ ঘটনায় সব থেকে বেশি ব্যথিত হয়েছিলেন আব্দুল খালেক। এ বিষয়ে আব্দুল খালেক আলো বলেন, ‘একজন নেতা কখন মারা যায় জানেন? যখন তার লোকরাই তাকে এবং তার সামর্থ্য নিয়ে সন্দেহ করে। আমি খুব অসহায় বোধ করতাম কিন্তু তাদের অনুভূতি বুঝতে পারতাম তাই চুপ করে থাকতাম।’

    এ সময় আমার মা একটি কথাই বললেন, ‘বাবারে তুই যুদ্ধে চলে যা। যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করতে হবে। প্রয়োজন হলে আমিও যুদ্ধে যাব।’

    যুদ্ধ এবং প্রতিশোধ

    আব্দুল খালেক আশাহত হয়েছিলেন বটে, হয়েছিলেন নিরাশও। তবে ঘটনা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। কারণ মানসিকভাবে ভীষণ দৃঢ় ছিলেন তিনি। ঘটনার দুদিন পরেই বড় ভাই রউফকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যান তিনি।

    জুনের মাঝামাঝি ভারতের আগরতলায় পৌঁছান তিনি। মেজর হায়দারের নেতৃত্বে সেক্টর ২-এ যোগদানের আগে মেলাঘর ক্যাম্পে এবং পরে তোফাজল হোসেনের অধীনে হাতিমারায় প্রশিক্ষণ শুরু করেন তিনি।

    পরে গজারিয়ার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নিয়োগ করা হয় আবদুল খালেককে। ১৩ আগস্ট তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন, প্রতিশোধের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ।

    আবদুল খালেক বলেন, ১৪ আগস্ট ছিল পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, তাই আমি গ্রেনেড দিয়ে গেরিলা হামলা চালিয়ে তাদের উদযাপন নষ্ট করার পরিকল্পনা করেছিলাম।

    তার ভাষ্য, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের গ্রামের অনেক পুরুষ, আমার ভাই, আমার চাচা ও আত্মীয়কে হত্যা করেছে। তারা অন্তত আটজন নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করেছে। এমনকি মসজিদের ভেতরও তারা এটা (ধর্ষণ) করেছে।’

    যেহেতু আমাদের গ্রামটি নদী তীরবর্তী ছিল, তাই গেরিলারা পাকিস্তানিদের ওপর ভালোভাবে হামলা করতে পেরেছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা ধারাবাহিক একের পর এক আক্রমণ অব্যাহত রাখি।’

    ‘এরইমধ্যে নভেম্বরের শেষ দিকে শান্তি কমিটির সদস্য খোকা চৌধুরীকে ধরতে সক্ষম হন মুক্তিযোদ্ধারা। তারপ্রতি সবাই এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে তাকে ৮৩ বার ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল,’ বলেন আবদুল খালেক।

    শান্তি কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন- শামসুদ্দিন, শ্যাম চৌধুরী, গফুর চৌধুরী এবং সৈয়দ মাহফুজুল্লাহ। খোকা চৌধুরীকে হত্যার পর তাদেরকে আর এলাকায় খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং সেই থেকেই তারা এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন।

    ১৪ আগস্টের পরেও ক্রমাগত ছোট ছোট গেরিলা দলে ভাগ হয়ে হানাদারদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন মুক্তিযোদ্ধারা। তবে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের ওপর কঠিন আঘাত হানা হয়। মরণপণ যুদ্ধের পর সেদিন বিকেলে ৬০ জনেরও বেশি সেনা সদস্য মেঘনা নদীর পাশে তৎকালীন গজারিয়া থানায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

    আরও অর্জন রয়েছে আবদুল খালেকের। তিনি জানিয়েছেন, মুক্ত গজারিয়ায় প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন তিনি। যার ফলে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, স্থানীয়রাও তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

    গর্বিত হাসি হেসে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘আমি তখন বুঝতে পারি গজারিয়ার জন্য আমি স্বাধীনতা পেয়েছি, আমার স্বপ্ন পূরণ করেছি এবং আমার সম্মানও ফিরে পেয়েছি।’

    সূত্র : কালবেলা